<p>‘ঢাকা ড্রিম’ নামে একটি সিনেমার শুটিং প্রায় শেষ, একটা লট বাকি। এই ছবি শুরু করার পরই ‘জন্মভূমি’র প্লট পেয়ে গেলেন প্রসূন। তর সইল না পরিচালকের। ‘ঢাকা ড্রিম’-এর আগে বানিয়ে ফেললেন ‘জন্মভূমি’। রোহিঙ্গাদের আত্মপরিচয়ের সংকট, শরণার্থী শিবিরে তাঁদের জীবনসংগ্রাম এবং জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার আকুতি এই ছবির পরতে পরতে। সিনেমার জন্য এমন গল্প কেন বেছে নিলেন? ‘রোহিঙ্গা কিন্তু একদম নতুন ইস্যু নয়। ২০১৭ সালে একসঙ্গে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। এর আগের ২০ বছরে বিভিন্ন সময়ে এসেছে দুই থেকে আড়াই লাখ লোক। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে প্রচুর তথ্যচিত্র হয়েছে। পৃথিবীর খুব কম টিভি চ্যানেল আছে, যারা এ নিয়ে তথ্যচিত্র করেনি। এখনো করছেন অনেকে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটা মানবিক গল্পের জন্য প্রায় ছয় মাস গবেষণা করি। ছয় মাস পর আমি কনভিনসড হই, হ্যাঁ এমন একটি গল্প নিয়েই ছবি করতে চাই।’</p> <p>গল্প বলার জন্য পরিচালক আশ্রয় করেছেন একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে। বাংলাদেশে যে ১০ লাখ রোহিঙ্গা এসেছে, এর মধ্যে ৬৫ হাজার অন্তঃসত্ত্বা নারী। তাদের অতীত ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, শরণার্থী শিবিরের ৮ ফিট বাই ১০ ফিট ঘর তাদের বর্তমান আর অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ। এমনই এক নারী সোফিয়া। তার আকাঙ্ক্ষা আর যন্ত্রণার গল্প ‘জন্মভূমি’। পর্দায় সোফিয়া হয়েছেন সায়রা জাহান।</p> <p>নিজেকে কতটা সোফিয়া করে তুলতে পেরেছেন সায়রা? ‘বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলাম। চট্টগ্রামের মেয়ে হলেও আমাদের বাসায় চাটগাঁইয়া ভাষার চর্চা নেই। রোহিঙ্গাদের ভাষা রপ্ত করতে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। শুটিং শুরুর বেশ কয়েক দিন আগে ওদের জীবনযাপন দেখার জন্য শরণার্থী শিবিরে গিয়েছিলাম। প্রসূন ভাইয়া ও রওনক ভাইয়া বেশ সাহায্য করেছেন। তাঁদের সাহায্য ছাড়া এই চরিত্র করা সম্ভবই হতো না—বললেন সায়রা।</p> <p>‘সোফিয়া’ নামটি বেছে নেওয়ার পেছনেও আছে গল্প। ‘গল্পটি নিয়ে যখন ভাবছিলাম, তখনই সোফিয়া নামের এক রোবট বিভিন্ন দেশে ঘুরছিল। সৌদি আরবসহ আরো কয়েকটি দেশ সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দিয়েছে রোবটটাকে। তখন মনে হয়েছিল, আমি একটা রক্ত-মাংসের সোফিয়ার গল্প বলব, যার কোনো নাগরিত্বক নেই। একই পৃথিবীর আলো-বাতাসেই আমাদের বেড়ে ওঠা। একদিকে ১০ লাখ লোককে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে নিজ ভূমি থেকে, তাঁদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না কেউই—একই সময়ে আমরা নাগরিকত্ব দিচ্ছি একটি রোবটকে!’</p> <p style="text-align: center;"><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/Print- 2018/12 December/13-12-2018/RM/KK_RM_13A.jpg" style="height:483px; width:800px" /></p> <p style="text-align: center;">নির্মাতা প্রসূন রহমান</p> <p>‘জাগো’র পর রওনকের দ্বিতীয় সিনেমা এটি। টেলিভিশনে অভিনয় করছেন বহুদিন ধরে। এত দিন পর সিনেমায় অভিনয়ের প্রথম কারণ জানালেন, ‘আমাকে কেউ নেয় না। অনেক পরিচালকের সঙ্গে কথা হয়, শেষ মুহূর্তে ছবি হয় না।’ এই সিনেমা নিয়ে বললেন, ‘বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। বাংলাদেশ এবং বৈশ্বিক রাজনীতির খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। প্রসূন রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। গল্পটি শোনার পর চোখের সামনে যে ইমেজটা ভাসল সেটাকে আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারিনি। মনে হয়েছে, এ ধরনের একটি ছবির সঙ্গে আমার থাকা উচিত।’</p> <p>ছবিতে রওনকের নাম মানিক। ১০ বছর আগে বার্মা (মিয়ানমার) থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে মানিক। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছোট ছিল তখন। সে স্বপ্ন দেখে কোনো এক সময় ফিরে যাবে। সেই জায়গা থেকে যখন সোফিয়া আসে তখন মানিকও দেশে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল। ‘অভিনয়ে নতুন হলেও সায়রা কুইক লার্নার। ছবি দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না ও অভিনয়ে নতুন’—বললেন রওনক।</p> <p>শরণার্থী শিবিরে থাকার অভিজ্ঞতা জানালেন সায়রা, ‘ওখানকার খাবার খেতে পারতাম না। নানা রকম পানিবাহিত রোগ হওয়ার আশঙ্কা ছিল। খুব ভোরে যেতে হতো শুটিংয়ে। অনেক কষ্ট! কষ্টটা আসলে গায় লাগেনি রোহিঙ্গাদের কষ্ট দেখে। ওদের এক একজনের গল্প শুনলে চোখের পানি ধরে রাখা সম্ভব হতো না।’</p> <p>রওনক বলেন, ‘হাজার হাজার মানুষ জমে যাচ্ছিল। ওদের কন্ট্রোল করে দৃশ্যায়ন করা বেশ কষ্টের। ওদের অনেক সাহায্যও নিয়েছি। উচ্চারণ শিখেছি, ওদের ঘর ব্যবহার করেছি।’</p> <p>রোহিঙ্গাদের মুখের ভাষার সঙ্গে চট্টগ্রামের ভাষার কিছুটা মিল আছে। এ কারণে চট্টগ্রামের শিল্পীদের প্রাধান্য দিয়েছেন পরিচালক। একজন বিদেশিও অভিনয় করেছেন। অনেক নির্মাতাই অভিযোগ করেন, সিনেমার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট পাননি। এমন অভিযোগ নেই প্রসূনের, ‘কাজটা যাঁরা প্যাশন থেকে করেন, চলচ্চিত্রটাকে শিল্প ভাবেন, তাঁদের কাছে বাজেট কোনো বিষয়ই নয়। গল্প বেছে নেওয়ার আগেই সেটা ভেবে রাখি। অনেক বাজেট হলেই ভালো কাজ হয়, তা মনে করি না।’ </p> <p>সিনেমাটি শুধু ঢাকার মাল্টিপ্লেক্সগুলোতেই মুক্তি পাচ্ছে। এ নিয়েও চিন্তিত নন পরিচালক, “এই ধরনের সিনেমা সাধারণত খুব বেশি হল পায় না। আমার প্রথম সিনেম ‘সুতপার ঠিকানা’ একসঙ্গে চারটি হল পায়নি। কিন্তু দেশের বাইরে মালেয়শিয়ায় চারটা মাল্টিপ্লেক্সে টানা সাত সপ্তাহ চলেছে। তারেক মাসুদের সঙ্গে ‘রানওয়ে’ নিয়ে দেশের ২২ জেলায় গেছি। ‘সুতপার ঠিকানা’ নিয়ে গেছি ১২ জেলায়। সিনেমাটা আগে মুক্তি পাক। মানুষ আগ্রহী হলে ছবি নিয়ে সারা দেশ ঘুরব। ফ্রি হলেও দেখাব। একজন ফিল্মমেকারের প্রশান্তি আসে তখনই, যখন মানুষ সিনেমাটি দেখে।”</p>