<p> মুগ্ধ ভাইয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, 'এইডা বহুত খরস্রোতা নদী, উঁচা-উঁচা ঢেউ। পা রাখতে পারবা না। ভাসায়া লইয়া যাইব গা। দড়ি লাগব, দড়ি ছাড়া কিছুতেই পার হইতে পারবা না। আর লাইফ জ্যাকেট তো মাস্ট।' পরে গিয়ে দেখা গেল একটা ছোট্ট নালা, হাঁটুর নিচে পানি মৃদু লয়ে বয়ে যাচ্ছে। তো মুগ্ধ ভাইয়ের সেই খরস্রোতা মাতামুহুরী পার হয়ে, পাহাড়ের সরু খাঁজের মধ্য দিয়ে অনেক কষ্টে শরীর গলিয়ে, ২০ ফুট খাড়া দেয়াল ফ্রিহ্যান্ড ক্লাইম্ব করে পৌঁছেছি আলীকদমের গুহায়।</p> <p> আলীকদমের এই গুহা আর সুড়ঙ্গ প্রাকৃতিক না কৃত্রিমভাবে মানুষের দ্বারা তৈরি, তা নিয়ে আছে নানা মুনির নানা মত। তবে জনশ্রুতি, অনেক কাল আগে এই অঞ্চলে আলী নামে একজন সুফি দরবেশ আসেন। দ্বীনের শিক্ষা দিতেন মানুষকে। খুব দ্রুত তিনি সাধারণ মানুষের মনে জায়গা করে নেন। সেটা দেখে স্থানীয় রাজা ভয় পেয়ে দরবেশকে গৃহবন্দি করে তাঁর চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। দরবেশ এই অত্যাচার থেকে বাঁচতে তাঁর শিষ্যদের নিয়ে একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করেন। অনেকেই বিশ্বাস করেন, এই সুড়ঙ্গ কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সময়ের পরিক্রমায় ভূমিকম্প আর বন্যায় দরবেশের সেই সুড়ঙ্গ বিলীন হয়ে গেছে। এখনো দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা এই গুহায় এসে দরবেশকে স্মরণ করেন। আগরবাতি আর মোমবাতি জ্বালিয়ে দোয়া চাইতে আসেন। সেই রকম কিছু নিদর্শনও পাওয়া গেল গুহার ভেতর।</p> <p> মোমবাতির আলোয় ভুতুড়ে আর রহস্যময় লাগছিল গুহাটি। গুহামুখ থেকে আসা বাতাসে যখন মোমের আলো তির তির করে কাঁপে তখন পাশের পাথুরে দেয়ালে নিজেদের কিম্ভূতকিমাকার ছায়া দেখে নিজেরাই ক্ষণিকের জন্য ঘাবড়ে যাই। গুহার ভেতর দেখা গেল বেশ কিছু বাদুড় ঝুলে থাকতে। আমাদের উপস্থিতিতে কাউকে কাউকে বিরক্তও হতে দেখলাম। ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ সাদাটে পাথর চুইয়ে পানি পড়ছে চারদিকে। তাই বোধ হয় গুহাটা অসম্ভব রকমের ঠাণ্ডা। পাহাড়কে তুচ্ছ করে মধ্যরাতের চাঁদের আলো গলগল করে ঢুকে পড়ে গুহামুখ দিয়ে। ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটা নিভিয়ে দেয় কথন। অপার্থিব রুপালি বন্যায় ভেসে যায় গুহার পাথুরে দেয়াল। আলো-ছায়ার খেলায় মেতে উঠি আমরা-পাথুরে দেয়ালে উড়তে থাকে পায়রা, পাশ থেকে রাইন ভাইয়ের সাপের ছায়া গিলে ফেলে কথনের পায়রাকে। ছায়াবাজির মধ্যেই চারদিক থেকে ভেসে আসছে রাতের বনের নানা রকম আওয়াজ। তারপরও প্রকৃতিতে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। গুহার ঠিক মুখেই একটা বিরাট পাথর অদ্ভুতভাবে শূন্যে ঝুলে আছে। দেখে মনে হয়, এখনই বুঝি গড়িয়ে নিচে পড়ে যাবে। সেই পাথরের ওপর বসে এক চিলতে আকাশের তারা দেখছে কথন। সময় কেটে যায়। ডুবে যায় চাঁদ। অন্ধকার পাহাড়ের খাঁজে বসে থাকি আমরা। নানা চিন্তা উঁকি দিয়ে যায় মনে। কিন্তু উত্তর ধরা দেয় না।</p> <p> গুহার পেছনে পাথুরে মেঝে শক্ত করে আঁকড়ে শুয়ে আছেন রাইন ভাই। কোনো একসময় চোখ লেগে এসেছিল। হঠাৎ এক গগনবিদারী আর্তনাদে চমকে তন্দ্রা ছুটে গেল। তাকিয়ে দেখি অদৃশ্য কাকে যেন ফুটবল কিক মারছেন রাইন চৌধুরী।</p> <p> কী হলো রাইন ভাই?</p> <p> খেপাটে গলায় উত্তর আসে, 'বজ্জাত চিকা। হামলা করছে। ইয়া বড়, সাদা চিকা। লাইট নেভালে আবার বের হয়ে আসবে।'</p> <p> টর্চ নিভিয়ে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকি গুহার পেছনের ফোকরের দিকে। একটু পরেই তাদের দেখা গেল। দুটি সাদা রোমশ ইঁদুর, গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। রাতের খাবার খেতে আমাদের আধোয়া পাতিলে মুখ দিচ্ছে। শহুরে ইঁদুরের মতো ত্যাঁদর মনে হলো না তাদের। বেশ শান্ত আর কিউট। হুশ হুশ করে ভয় দেখালে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। একটুও ভয় পায় না। বরং অবাক হয়।</p> <p> 'এরা থাকলে কিছুতেই ঘুমাতে পারব না। সারা রাত জেগে থাকব', বলে আধা ঘণ্টার মধ্যেই রাইন ভাই গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কথনও কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে সেই ঝুলে থাকা পাথরের ওপর।</p> <p> ছবি : লেখক</p> <p> <a name="FIMG0"></a></p>